![]() |
ছবিটি Science Bee পেইজ থেকে নেওয়া |
কথিত আছে আইনস্টাইন নাকি বলেছেন যদি পৃথিবী থেকে সব মৌমাছি হারিয়ে যায় তাহলে মানব সভ্যতা টিকবে মাত্র চার বছর। কিন্তু আসলেই কি আইস্টাইন এমন কথা বলেছেন? আর কী হবে যদি সত্যি সত্যি মৌমাছি হারিয়ে যায়?
মৌমাছি মধু ও মোম উৎপাদন এবং ফুলের পরাগায়ণের জন্য প্রসিদ্ধ। পৃথিবীতে ৯টি স্বীকৃত গোত্রের অধীনে প্রায় বিশ হাজার মৌমাছি প্রজাতি আছে, যদিও এর বেশিরভাগেরই কোন বর্ণনা নেই এবং এর প্রকৃত সংখ্যা আরো বেশি হতে পারে। আন্টার্কটিকা ব্যতীত পৃথিবীর সকল মহাদেশে যেখানেই পতঙ্গ-পরাগায়িত সপুষ্পক উদ্ভিদ আছে, সেখানেই মৌমাছি আছে।
প্রত্যেকটি মৌচাকে মৌমাছিরা বসতিবদ্ধ হয়ে একটি বড় পরিবার বা সমাজ গড়ে বাস করে ৷ বর্তমানে পৃথিবীতে মৌমাছির প্রায় বিশ হাজার প্রজাতি আছে। আকার ও কাজের ভিত্তিতে মৌমাছিরা তিন সম্প্রদায়ে বিভক্ত:
১৷ রানি মৌমাছি, যা একমাত্র উর্বর মৌমাছি
২৷ ড্রোন বা পুরুষ মৌমাছি
৩৷ কর্মী মৌমাছি বা বন্ধ্যা মৌমাছি
সাধারণত অনেক ধরণের ফুল বা ফল হওয়ার জন্য বা ফুল থেকে ফলে পরিণত হওয়ার জন্য পরাগরেণুকে (প্রজননের উপাদান) ফুলের গর্ভমুন্ডে এসে পড়তে হয়। পরাগরেণু গর্ভমুন্ডে আসলেই ফুল, ফুল ইত্যাদি পরিপূর্ণ হয়ে গড়ে উঠে। এই প্রক্রিয়াকেই মূলত পরাগায়ন বলে।
পরাগায়ন দু-ধরনের হয়ে থাকে। একটি হলো স্ব-পরাগায়ন ও আরেকটি হলো পর-পরাগায়ন।
স্ব-পরাগায়ন মানে যে নিজে নিজে পরাগায়ন সম্পন্ন করতে পারে। তবে এক্ষেত্রে শর্ত থাকে পরাগরেণু ও গর্ভমুন্ড একই ফুলের বা একই গাছের হতে হবে। এবং পর-পরাগায়ন মানে হলো যেখানে পরাগায়ন সম্পন্ন হতে অন্যের সাহায্য লাগে। যেমন মৌমাছি, বাতাস বা অন্যান্য পোকামাকড়। এই প্রক্রিয়াতেই পৃথিবীতে সবচেয়ে বেশি খাদ্যশস্য উৎপন্ন হয়। বাতাসের মাধ্যমে পরাগরেণু উড়ে গিয়ে অন্য কোন ফুলের গর্ভমুন্ডে পড়লে সেখানে নতুন ফল বা ফুল উৎপন্ন হয়। কিংবা পোকামাকড় একটা ফুলের উপর বসলে ফুল থেকে তাদের শরীরের বিভিন্ন অংশে বা মুখে পরাগরেণু লেগে যায়, পরে আবার উড়ে উড়ে অন্যকোন ফুলের উপর বসলে পরাগরেণু ফুলের গর্ভমুন্ডে পড়ে। পড়লে সেখানে ফল বা ফুল উৎপন্ন হয়।
আর মৌমাছির কাজই হচ্ছে ফুলে ফুলে ঘুরে বেড়ানো। কারণ তারা ফুল থেকে মধু সংগ্রহ করে সবসময়। ফলে তারাই সবচেয়ে বেশি ফুলে ফুলে ঘোরে। তারা ফুলে ফুলে ঘুরলেই আমাদের জন্য খাবার তৈরি হয়।
আমাদের পৃথিবীর একতৃতীয়াংশ খাবারের যোগানে প্রত্যক্ষভাবে অবদান রয়েছে মৌমাছির। গবেষণা বলছে, পৃথিবীর সর্বশেষ মৌমাছিটি মারা যাওয়ার ঠিক তিন মাসের মধ্যে সারাবিশ্বের ফুড চেইন পুরোপুরিভাবে ভেঙ্গে পড়তে পারে, বিশৃঙ্খল সৃষ্টি হবে। আমরা আমাদের নিত্য প্রয়োজনীয় বেশিরভাগ খাবারই হাতের নাগালে পাবো না। বলা হচ্ছে, তখন অনেক দামি হিরা, জহরতের চেয়ে খাবারের দাম বেশি থাকবে। আর, একসময় আমাদের সংরক্ষণ করা খাবারও শেষ হবে! শুধুই কী খাবার? মৌমাছি না থাকলে আমরা কোন ধরণে কটন সমৃদ্ধ জামা-কাপড়ও তৈরি করতে পারবো না। কারণ মৌমাছি না থাকলে গার্মেন্টস ইন্ডাস্ট্রির অন্যতম কাঁচামাল তুলা কখনো উৎপন্ন হবে না। ফলে জামা-কাপড়ের তীব্র সংকট দেখা দিবে।
পরিবেশের ভারসাম্য পুরোপুরিভাবে নষ্ট হয়ে যেতে পারে, খাবারের সংকট ভয়াবহ আকার ধারণ করবে। একসময় হয়তো আমাদের পৃথিবী আর বসবাস উপযোগী থাকবে না। মহাবিশ্বের অন্যান্য গ্রহের মতো মানুষ বসবাসের অনুপযোগী হয়ে যাবে। কিন্তু বর্তমানে কীটনাশকে রয়েছে নিওনিক্স নামক উপাদান যা মৌমাছিদের মেরে ফেলে। কীটনাশক ফসলকে রক্ষা নয় বরং ধ্বংসের মুখে ঠেলে দিচ্ছে উপকারী কীটকে।
আচ্ছা এতক্ষণ তো মৌমাছি না থাকলে কী হবে সেটা সম্পর্কে জানলাম। এখন মূল প্রশ্নে ফেরত আসা যাক। আইনস্টাইন কী আসলেই এমন কোনো ভবিষ্যৎ বাণী করেছেন? সঠিক উত্তর হচ্ছে না। ফ্যাক্ট চেকিং ওয়েবসাইট Snopes এর মতে আইনস্টাইন এমন কোনো ধরণের উক্তি কখনও করেননি। তার উক্তির লিস্ট ঘেটেও ৪ বছর কিংবা মৌমাছি নিয়ে কোনো ধরণের উক্তি খুজে পাওয়া যায়নি৷ এমনকি ১৯৫৫ সালে আইনস্টাইনের মৃত্যু থেকে ১৯৯৩ সাল পর্যন্ত কোনো ম্যাগাজিন বা নিউজপেপারও এমন কোনো নিউজ আসেনি। কিন্তু ১৯৯৪ সাল থেকে ম্যাগাজিন গুলোতে আইনস্টাইনকে কোট করে এই উক্তিটি ছড়ানো শুরু হয়। এরপর ইন্টারনেটের ব্যবহার বৃদ্ধি পেলে এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের উত্থানের পর এই গুজব আরো মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে৷
তাহলে সব কথার এক কথা এই যে মৌমাছি যদি কোনো কারণে বিলুপ্ত হয়ে যায় তাহলে ৪ বছরের মধ্যে মানব সভ্যতা বিলুপ্ত হয়ে যাবে এমন কোনো উক্তি আইনস্টাইন করেননি। এর পাশাপাশি মৌমাছি বিলুপ্ত হয়ে গেলে পৃথিবীর অভাবনীয় ক্ষতি হবে ঠিকই কিন্তু ৪ বছরের মধ্যেই যে আমরা বিলুপ্ত হয়ে যাব এমন ভবিষ্যৎ বাণীরও কোনো সত্যতা পাওয়া যায়নি৷
লেখকঃ Promity | Science Bee
#science #bee
Post a Comment