প্রাচ্যের স্কটল্যান্ড খ্যাত ভারতের মেঘালয় রাজ্যের রাজধানী-শিলং ও বিশ্বের সর্বাধিক বৃস্টিপাতের শহর-চেরাপুন্জি ভ্রমনের অভিজ্ঞতা

 

প্রাচ্যের স্কটল্যান্ড খ্যাত ভারতের মেঘালয় রাজ্যের রাজধানী-শিলং ও বিশ্বের সর্বাধিক বৃস্টিপাতের শহর-চেরাপুন্জি ভ্রমনের অভিজ্ঞতা শেয়ার করছিঃ


শিলং উত্তর-পূর্ব ভারতের সেভেন সিস্টার রাজ্যের একটি,মেঘালয় রাজ্যের পূর্ব খাসি হিল জেলার একটি শহর ও মেঘালয়ের রাজধানী।বাংলাদেশ-ভারত সীমান্ত তামাবিল- ডাউকি থেকে ৬৫ কিমি উত্তরে খাসি পাহাড়ে প্রায় ১৫০০ মিটার উচ্চতায় অবস্থিত। আয়তন ৬৫ বর্গকিমি এবং জনসংখ্যা প্রায় ৩,৫৪,০০০ 


কখন যাবেনঃ 


মেঘালয় মানে মেঘের বাড়ি, যেখানেই যাবেন মেঘ ও কুয়াশার দেখা মিলবে যদি আপনি বর্ষায় যান।এপ্রিল টু অক্টোবর আপনি মেঘের দেখা পাবেন এবং ঝর্ণাগুলিতে প্রচুর পানি দেখবেন যা মেঘালয় ভ্রমনের স্বার্থকতা।তবে এসময়টাতে আকাশ মেঘাচ্ছন্ন হওয়ায় দুরের ঝর্ণা ও ভিউ দেখতে অসুবিধা হতে পারে।

নভেম্বর টু মার্চ শীতকালে ঝর্ণাগুলিতে পানি অনেক কম থাকে কিন্তু দুরের ভিউ ক্লিয়ার দেখা যায় এবং আকাশে বৃস্টি না থাকাতে ঘুরেও মজা পাওয়া যায়।


তামাবিল- ডাউকি বর্ডারঃ 


শিলং যেতে আপনাকে বাংলাদেশের তামাবিল ও ভারতের ডাউকি বর্ডার দিয়ে গেলেই সবচেয়ে সহজ ।সিলেট থেকে তামাবিল বর্ডারের দুরত্ব ৫০ কিঃমিঃ যা জাফলং বাজারের ৫ কিমি পুর্বে। সিলেট টু জাফলং বা ঢাকা টু জাফলংয়ের গাড়ীতে সহজেই তামাবিল বর্ডার মেইন রাস্তায় নেমে ৩ মিনিট হেটে ইমিগ্রেশনে যাওয়া যায়। 


ইমিগ্রেশনঃ 


সকাল ৯ টায় বাংলাদেশ ইমিগ্রেশন অফিসের কার্যক্রম শুরু হয় এবং বিকাল ৫ টা পর্যন্ত চলে।আপনি ইমিগ্রেশন শেষ করে কাস্টমস হাউসে কাস্টমস শেষ করে বিডিআর এর খাতায় পাসপোর্ট এন্ট্রি করতে ১৫-৩০ মিনিট লাগবে।কাস্টমস অফিসে আপনাকে ৫০০ টাকার ট্রাভেল ট্যাক্সের কপি দিতে হবে যা আপনি আগেই ঢাকা বা আপনার শহরের সেনালী ব্যাংক থেকে করে নিবেন।বর্ডারের ব্যাংকেও পরিশোধ করা যায় তবে এক্ষেত্রে আপনার ১ টা ঘন্টা অপচয় হবে, পোর্ট এরিয়ায় নির্ধারিত ব্যাংকে ভ্রমণ কর জমা দিয়ে কাস্টমস হাউসের ফর্মালিটিজ শেষ করতে হবে।


বাংলাদেশের সমস্ত দাপ্তরিক কাজ সেরে আপনি ভারতের এরিয়ায় ঢুকে যাবেন এবং প্রথমেই আপনাকে বিএসএফের খাতায় নাম এন্ট্রি করিয়ে ইমিগ্রেশন ও কাস্টমস অফিসের কাজ শেষ করতে হবে। ইমিগ্রেশন অফিস একটু দুরে হওয়ায় অনেকেই ভুল করে ভারতের ইমিগ্রেশন ও কাস্টমস না করেই গাড়িতে উঠে পড়ে।আমাদের সাথের একটি দলের এমন হয়েছিল এবং আসার দিন অনেক ঝামেলা শেষে জরিমানা গুনে ইমিগ্রেশন পাড় হয়েছিল।


গাড়ী ভাড়াঃ 


ভারতের ইমিগ্রেশন ঘরের ঠিক পরে আপনি ছোট একটি গাড়ীর পার্কিং পাবেন যেখান থেকে আপনি শিলং বা চেরাপুন্জির গাড়ী পেয়ে যাবেন। এখানে গাড়ী কম থাকায় ও সিন্ডিকেটের কারণে ভাড়া ৫০০-১০০০ বেশি লাগবে।১ কিমি দুরে ডাউকি বাজারে অনেক গাড়ী পাবেন যা কিছুটা সাশ্রয়ী হবে।ডাউকি বাজারে বাংলা টাকা ও ডলার পরিবর্তন করে রুপিতে নিয়ে যাবেন।ডলার শিলং এ ভাল রেট পাবেন।চাইলে ডাউকি বাজার থেকে মোবাইলের সিম কিনে নিতে পারেন সুবিধাজনক ইন্টারনেট প্যাকেজসহ।


ডাউকি থেকে ৪ জনের ট্যাক্সি ২০০০-২২০০ টাকা,৬ সিটের ইনুভা ২৫০০-৩০০০, ৮-১০টয়োটা সমু জিপ ৩০০০-৩৫০০ পেয়ে যাবেন।গাড়ী ও যাত্রীর পরিমানের উপর নির্ভর করে ভাড়া কিছুটা কমবেশি হতে পারে।লোকাল ড্রাইভার থেকে শিলং বা আসামের ড্রাইভার ভাল এবং কম পয়সায় ফিরতি ট্রিপ নিয়ে চলে যেতে চায়।


দর্শনীয় স্থান সমূহঃ 


আপনি ২ ভাবে আপনার ট্রাভেল প্ল্যান করতে পারেন।

১। প্রথমে রাস্তায় পড়বে উমক্রেম ঝর্না,বোরহিল ঝর্ণা,এশিয়ার সবচেয়ে পরিস্কার পরিচ্ছন্ন গ্রাম মাওলিনং ভিলেজ, লিভিং রুট ব্রিজ বা জীবন্ত গাছের শিকড়ের সেতু, ব্যালেন্সিং রক দেখে সরাসরি শিলং গমন ও রাত্রিযাপন এবং তারপর দিন শিলং থেকে চেরাপুন্জির উদ্দেশ্যে ভ্রমন যেখানে দেখা যাবে এলিফ্যান্ট ঝর্ণা,নোহকালিকাই ঝর্না,সেভেন সিস্টার ঝর্ণা ও মাউসমাই কেইভ বা গুহা ।


২।উপরে উল্লেখিত রাস্তায় পড়বে সেসকল স্পট তা দেখে সরাসরি চেরাপুন্জি গমন ও রাত্রিযাপন এবং তারপর দিন সকালে চেরাপুন্জি থেকে রওয়ানা দিয়ে পথিমধ্যে সকল দর্শনীয় স্পট দেখে শিলং এ গমন ও রাত্রিযাপন।

(আমি ২ নং টা করেছি)


৩য় দিন শিলং সিটি ট্যুর ও ফ্রি ডে হিসাবে শপিং এর জন্য বরাদ্দ রাখতে পারেন পুরা বিকাল ও রাত।শিলং সিটি ট্যুরে উমিয়াম লেক, ওয়ার্ডস লেক,গ্রান্ড ক্যানিয়ান,গল্ফ মাঠ,ডন বসকো মিউজিয়াম উল্লেখযোগ্য।


৪র্থ ও শেষদিন সকাল সকাল হোটেল চেক আউট করে গাড়ি ভাড়া করে ফেরার পথে উমনগট নদীর স্বচ্ছ পানিরসোনাংপেডাং গ্রাম,সাসপেনশন ব্রিজ ও ক্রাংসুরি ঝর্ণা দেখে বিকাল ৪ টার আগে ডাউকি ইমিগ্রেশন শেষ করে বাংলাদেশ ইমিগ্রেশনে পৌছতে হবে।ফেরার পথে গাড়ি ভাড়ার সময় অবশ্যই এ সকল স্পটগুলি দেখানোর কথা বলতে হবে।যারা ৩ দিনেই ফিরে আসবেন তারা ২য়,৩য় ও ৪র্থ দিনের ট্যুর ২ দিনে এডজাস্ট করে নিবেন।


থাকা ও খাওয়াঃ


শিলং শহরে বাংলাদেশের পর্যটকরা প্রায় সবাই পুলিশ বাজার সেন্টারের আশে পাশের হোটেলেই থাকে।পুলিশ বাজারে হোটেল,খাওয়া, শপিং ও ঘোরাঘুরির গাড়ি পাওয়া সহজ।

আমরা পুলিশ বাজারের নিকটেই মসজিদের পাশে হোটেল রয়েল নামে একটি আবাসিক হোটেলে ছিলাম, যেটার ঠিক নিচেই ছিল হালাল মুসলিম বাদশা মিয়ার খাবারের হোটেল।পুলিশ বাজারের প্রায় সব হোটেলের ম্যানেজার বাংলা বুঝে বা বলতে পারে। কারন তারা বা তাদের পূর্বপুরুষ সবাই বাংলাদেশি ছিল।হোটেলের ভাড়া ৭০০ -২৫০০ রুপিতে পেয়ে যাবেন তবে অবশ্য দেখে দামাদামি করে নিবেন। এখানে প্রায় সব আবাসিক হোটেল বার্গেনিং চলে।যারা বাজেট ট্যুর দিতে আগ্রহী তারা একটু দুরে যাচাই করলে ৮০০-১০০০ রুপিতে ডাবল রুম পেয়ে যাবেন,যেখানে ২-৩ জন অনায়াসে থাকতে পারবেন।


খাওয়া দাওয়া ও খুবই সস্তা, এখানে মেনু চয়েজের পাশাপাশি প্যাকেজ খাবার বা থালি হিসাবে পাওয়া যায়। যেমন ভেজ থালি ৯০-১৩০ রুপিতে পাওয়া যায়। ভেজ মানে ভেজিটেরিয়ান খাবার, ভাত, ভাজি, ডাল,পাপড়,বেগুন ভাজি সহ বিভিন্ন ভর্তা ও চাটনী। যাদের হালাল খাবারের জন্য আগ্রহ বেশি তাদের জন্য ভেজ থালিই বেস্ট অপশন।এছাড়াও ফিস থালি বা মিট থালি ও আছে নন ভেজিটেরিয়ান বা মাংশভূকদের জন্য।

ট্যুরিস্ট অঞ্চল হিসাবে প্রায় সকল খাবার হোটেলে সব জাতি ধর্ম নির্বিশেষে সবাই যেন নির্দিধায় সব খেতে পারে এমন সব খাবারই তালিকায় থাকে।খুব কম সংখ্যক খাবার হোটেলেই আপনি গরুর গোশত বা শুকরের গোশতের মেনু পাবেন।সেন্টার পয়েন্টের পাশে ইডেন গার্ডেন রেস্টুরেন্টটিও হালাল খাবার পরিবেশন করে যা তুলনামুলক দামী সকল আইটেম পাবেন।এছাড়া শিলং শহরের রাস্তার উপর পাবেন স্ট্রীট ফুড যা শিলং এর সাধারন জনগনের খাবার। অবশ্যই এগুলি ট্রাই করবেন লোকাল খাবারের স্বাদ গ্রহনের জন্য।


শপিং এর জন্য পুলিশ বাজার এরিয়া বেস্ট , বড় শপিংমল থেকে ফুটপাত জুড়ে থাকে বিভিন্ন জিনিসের পশরা।যারা সহজে ও কম সময়ে একদামে পণ্য কিনতে চান তারা বিশাল বাজারে সকল জিনিস একই দোকানে পেয়ে যাবেন।আমার দেখা শীতবস্রের দাম সস্তা ও কোয়ালিটি ভাল,২০০-৩০০ টাকায় আপনি উলের ভাল শাল চাদর পেয়ে যাবেন।


খরচঃ 

কমবাজেটের পর্যটকরা অবশ্যই ৩-৪ জনের গ্রুপে গেলে ৩ দিনের বাজেট ট্যুরে প্রতিজনের আনুমানিক ৬-৭ হাজার ভারতীয় রুপিতে হয়ে যাবে।২ জন গেলে এবং স্ট্যান্ডার্ড ট্যুরে প্রতি জনের ৭-৮ হাজার রুপি লাগবে।৪ দিনের ট্যুর হলে খরচ কিছুটা বাড়বে।৮-১০ জনের গ্রুপ হলে জনপ্রতি খরচ কমবে।


ভ্রমনের সময় আশেপাশের পরিবেশের দিকে সবাই খেয়াল রাখবো।চিপসের প্যাকেট ও পানির বোতল ডাস্টবিনে ফেলে পরিবেশ পরিচ্ছন্ন রাখবো।বাংলাদেশী হিসাবে বিদেশের মাটিতে দেশের ভাবমুর্তি অক্ষুন্ন রাখবো। নিরাপদ ভ্রমনের জন্য সচেস্ট থাকবো।

লিখেছেন : Mejbah Uddin Ahmed Ripon

Post a Comment

Post a Comment (0)

Previous Post Next Post