একসাথে বেশি পরিমাণ খাবার খেলে তা দেহে যেসব পরিবর্তন আনতে পারে তার মধ্যে একটি হলো আরো বেশি ক্ষুধা অনুভব করা। অবশ্য পাকস্থলীর আকার বাড়ে বলেই এমনটি হয় তা কিন্তু নয়।
আমি মোটামুটি আত্মবিশ্বাসী যে বেশি পরিমাণ খাবার খাওয়ার পর আমার কেমন লাগবে: ঝিমুনি ভাব, আসলেমি লাগা এবং অবশ্যই পেট পুরো ভর্তিভাব। কিন্তু আমি এটাও নিশ্চিত যে পরের দিন দুপুরের খাবারের সময় আমি অতিরিক্ত একটি রোস্ট খাওয়ার জায়গা ঠিকই করে নিবো।
যখন আপনি এটা ভাববেন তখন বেশ অবাকই লাগবে যে, বিশাল পরিমাণ খাবার খাওয়ার ঠিক পরের দিনই আপনি একদম আগের দিনের মতোই একই পরিমাণ খাবার আবার খেতে পারবেন। তার মানে প্রথম বারে কি আমাদের শিক্ষা হয়নি?
বড় কোন উৎসবের দিনের ভোজের পরও আমরা কেন আবার ক্ষুধার্ত অনুভব করি?
অতিরিক্ত খাওয়া কি আমাদের পাকস্থলীর আকার বাড়িয়ে দেয়? মানে পরের দিন কি আপনার পাকস্থলীতে আরো বেশি খাবার রাখার মতো জায়গা তৈরি হয়?
এটা ভেবেও এখন আমার আবার ক্ষুধা লাগছে।
এর উত্তর হচ্ছে, বেশিরভাগ মানুষের ক্ষেত্রে, সম্প্রতি আপনি যে অনেক বেশি পরিমাণ খাবার খেয়েছেন তার জন্য ক্ষুধা অনুভব করেন না। আপনি শুধু ক্ষুধার জন্যই ক্ষুধা অনুভব করেন।
কিন্তু সবার আগে, ক্ষুধার অনুভূতিটা আসলে কি?
আসলে কোন কিছু খাওয়ার জন্য আপনি যে তাড়না অনুভব করেন, তা আপনার দেহের ভেতরে বেশ কিছু শারীরবৃত্তীয় পরিবর্তনের কারণে হয়।
এটা সত্য যে আপনি যখন ক্ষুধার্ত থাকেন তখন আপনার পাকস্থলীর আকার পরিবর্তিত হয়। পাকস্থলী সংকুচিত হয় যখন খাবার হজম হয়ে অন্ত্রের দিকে যায়। পেটে গুড়গুড় শব্দ হয় যখন বাতাস আর খাবার একসাথে নিচের দিকে নামতে থাকে।
আমাদের যে ক্ষুধা লাগতে যাচ্ছে এই শব্দ হচ্ছে তার প্রথম সংকেত, কারণ এটা শোনা যায় এবং এটি শরীরেই ঘটে।
শব্দ তৈরির পর পাকস্থলী আবার প্রসারিত হতে থাকে নতুন খাবার গ্রহণের প্রস্তুতি হিসেবে- এগুলো হয় হরমোনের প্রভাবে।
তবে খাবার খেলে যে পাকস্থলী বড় হয় সেটি অবশ্য সত্য নয়। পাকস্থলী বেশ স্থিতিস্থাপক। তাই বেশি পরিমাণে খাবার খাওয়ার পরও এটি আবার এর আগের অবস্থায় ফিরে আসে(প্রায় ১-২ লিটারের মতো)। বাস্তবিক পক্ষে বেশিরভাগ মানুষের পাকস্থলী সক্ষমতার দিক থেকে প্রায় একই- উচ্চতা কিংবা ওজন কোন কিছুই তেমন প্রভাব ফেলে না।
আমরা যে বিষয়টি নিয়ে তেমন সচেতন থাকি না সেটি হচ্ছে ক্ষুধাজনিত হরমোনের নিঃসরণ: পাকস্থলী থেকে ঘ্রেলিন ও হাইপোথ্যালামাস থেকে নিঃসৃত এনপিওয়াই বা নিউরোপেপটাইড ওয়াই এবং এজিআরপি নামে হরমোন । পাকস্থলী খালি থাকলে ঘ্রেলিন নিঃসরিত হয় এবং এটি আমাদের মস্তিষ্কে এনপিওয়াই ও এজিআরপির উৎপাদন শুরু করাতে ভূমিকা রাখে। এই দুটি হরমোনই ক্ষুধার অনুভূতি তৈরির জন্য দায়ী, যা কিনা আমাদের মানসিক সন্তুষ্টির অনুভূতিকেও ছাপিয়ে যায়।
অন্যদিকে অনেকটা উল্টোভাবেই, স্থূলকায় দেহের অধিকারীদের তুলনায় চিকন দেহের অধিকারীদের মধ্যে ঘ্রেলিনের মাত্রা বেশি থাকে। আপনার মনে হতে পারে, যে হরমোনের কারণে ক্ষুধার অনুভূতি হয় সেটি, যে ব্যক্তি বেশি খায় তার মধ্যে বেশি থাকবে- কিন্তু এই বৈপরীত্বই প্রতিফলিত করে যে আমাদের পরিপাকতন্ত্র কতটা জটিল।
যখন ক্ষুধা অনুভূত হওয়ার জন্য মাত্র তিনটি হরমোন দরকার হয়, সেখানে আমাদের পরিতৃপ্ত হওয়ার জন্য প্রায় ডজনখানেক বা তারও বেশির দরকার হয়।
এদের মধ্যে জিআইপি এবং জিএলপি-ওয়ান, শর্করার বিপাক ক্রিয়া স্বাভাবিক রাখার জন্য প্রয়োজনীয় ইনসুলিন তৈরিতে ভূমিকা রাখে। অন্য বেশ কিছু হরমোন আমাদের পাকস্থলীতে খাবারের চলাচল ধীর রাখতে কাজ করে যাতে আমাদের দেহ খাবার হজম করার পর্যাপ্ত সময় পায়।
যারা স্থূলকায় এবং যাদের দেহে ঘ্রেলিনের মাত্রা কম থাকে, হতে পারে যে তাদের দেহে উচ্চ মাত্রার শর্করা হজম করার জন্য যে উচ্চ মাত্রার ইনসুলিন দরকার হয় তা ঘ্রেলিনের উৎপাদনকে বাধাগ্রস্ত করে।
দুটি বস্তু ক্ষুধা কম অনুভূত হওয়ার সাথে সংশ্লিষ্ট: সিকেকে এবং পিওয়াওয়াই। যেসব রোগীর দেহে পাকস্থলীর আকার ছোট করার জন্য গ্যাস্ট্রিক ব্যান্ড লাগানো থাকে, তাদের দেহে পিওয়াওয়াই অনেক বেশি থাকে। এর কারণে ক্ষুধা কমে যায়।
পাকস্থলীতে যে আলাদা হরমোন ব্যবস্থা রয়েছে সেটি পাকস্থলী খালি হলেই আপনার মস্তিষ্ককে জানান দেয়।
তারপরও আপনার অভ্যাস অনুযায়ী দিনের নির্দিষ্ট সময় এবং ক্ষুধা লাগার একটা শিক্ষাও এই হরমোন পেয়ে যায়। তাই আপনি দুপুরে যতই খান না কেন, এরপরও আপনি রাতের খাবারের সময় হলে ক্ষুধার্ত অনুভব করবেন।
সেন্টারডাটা এবং সাবেক মাস্ট্রিক্ট ইউনিভার্সিটির গবেষক ক্যারোলিয়েন ভ্যান ডেন আক্কার বলেন, “আপনি যদি বার বার রাতের খাবারের পর কোন একটি চকলেটের টুকরা বা চিপস হাতে নিয়ে গিয়ে সোফায় বসে টিভি দেখেন, তাহলে আমাদের দেহও সোফায় বসা, টিভি দেখা এবং সেসময় কিছু খাওয়ার সাথে অভ্যস্ত হয়ে যেতে পারে। আর এর ফলে আপনি যখন সোফায় বসবেন তখন আপনার কিছু খেতে ইচ্ছে করবে।”
“এটা তখনও হতে পারে যখন আপনি পরিতৃপ্ত: আপনার দেহে শক্তির মাত্রাও কানায় কানায় পূর্ণ।”
ভ্যান ডেন আক্কার এর মতে, অতিরিক্ত খাওয়া আসলে সব সময় খারাপ নয়। বরং অনিয়ন্ত্রিত খাবার খাওয়া বা বিঞ্জ ইটিং অর্থাৎ যেখান অল্প সময়ে অনেক বেশি পরিমাণ খাবার খাওয়া হয়, যা বেশিরভাগ সময় ঘৃণা, অপরাধবোধ বা লজ্জার উদ্রেক করে।
অতিরিক্ত খাবার খাওয়াটা একটা অভ্যাসের মতো, যা অনেকেই মনে করেন যে তারা চাইলে ছেড়ে দিতে পারেন, কিন্তু অভ্যাসগত খাবার খাওয়ার তীব্র আকাঙ্খার কারণে কোন একটি খাদ্যতালিকা অনুসরণ করাটা কঠিন হয়ে পড়তে পারে।
যখন আমরা কোন খাবারের ভাল উপাদানের সাথে বিশেষ করে উচ্চ মাত্রায় চিনি রয়েছে এমন খাবারের যোগ করতে শুরু করি, নির্দিষ্ট সময়ে, সেটির সুবাস, চিত্র এবং বৈশিষ্ট্য আমাদের স্মৃতিকে জাগিয়ে তোলে এবং আমরা সেটির জন্য তীব্র আকাঙ্খা অনুভব করি। এটা শুধু আমাদের মানসিকভাবে তাড়িত করে না বরং সেটির শারীরিকভাবেও উদ্দীপ্ত করে- যেমন জিভে জল চলে আসা।
আপনি হয়তো পাভলভের কুকুরের পরীক্ষার কথা জানেন- যেখানে কুকুরকে খাবার দেয়ার আগে আগে একটি ঘণ্টা বাজানো হয়। এক পর্যায়ে দেখা যায় যে, ঘণ্টার আওয়াজ শুনলেই কুকুরের মুখ থেকে লালা ঝড়তে শুরু করে। এক্ষেত্রে মানুষও কুকুরের চেয়ে খুব বেশি আলাদা নয়।
আরেকটি পরীক্ষায়, মানুষকে বৃত্ত আর বর্গের মতো সাধারণ চিত্র দেখানো হয়। তারা যখন বর্গক্ষেত্র দেখতো তখন তাদের এক টুকরা চকলেট দেয়া হতো এবং এ কারণে যখনই তারা বর্গক্ষেত্র দেখতো তখন তাদের মধ্যে চকলেট পাওয়ার তীব্র আকাঙ্খা হতো।
কুকুরের মতো মানুষকেও সাধারণ কিছু বৈশিষ্ট্যের উপর ভিত্তি করে খাবারের আশা করানো সম্ভব।
ভ্যান ডেন আক্কার বলেন, “এই মিথষ্ক্রিয়া খুব তাড়াতাড়ি এবং খুব অল্প পরিমাণ চকলেট দিয়েও গড়ে তোলা সম্ভব।” “এই আকাঙ্খাগুলো গড়ে তোলা খুব সহজ, কিন্তু এগুলো থেকে বের হওয়াটা কঠিন।
আপনার দেহ মনে রাখে যে কোন এক সময়ে আপনি চকলেট খেয়েছিলেন। এই আকাঙ্খা প্রতিদিনের আকাঙ্খায় পরিণত হতে পারে- এমনকি শুধুমাত্র চার দিনের নিয়মিত অভ্যাসেই এটা সম্ভব।”
অনেক সময় আমাদের মনের ভাব এই অবস্থা তৈরির কারণ হতে পারে। মানুষ সাধারণত বলে যে, তাদের মন খারাপ থাকলে বা ক্লান্ত থাকলে তাদের নিজের উপর নিয়ন্ত্রণ কম থাকে।“এক্ষেত্রে আবেগ সরাসরি মুখরোচক খাবারের সাথে সংশ্লিষ্ট হতে পারে, এবং তখন মন খারাপই খাবারের জন্য আকাঙ্খা বাড়াতে পারে,” বলেন ভ্যান ডেন আক্কার।
নীতিগতভাবে, যেকোন মেজাজ এমনকি ইতিবাচক মনোভাবও আকাঙ্খা তৈরি করতে পারে যদি ধারাবাহিকভাবে বিষয়টি খাবারের সাথে জড়িত থাকে।
এটা বারবারই দেখা গেছে যে আমরা বন্ধুদের সাথে থাকলে বেশি খাই। এমনকি যখন আমরা অ্যালকোহল নিয়ন্ত্রণ করি, বিশেষ উৎসবে বিভিন্ন কারণে যখন আপনি খাবার টেবিলে বেশি সময় ব্যয় করেন, সামাজিকতার কারণেই তখন বেশি খাওয়া হয়। কারণ তখন আমাদের আশেপাশে যে সঙ্গীরা থাকে তাদের কারণে আমরা কতটুকু খেলাম সেই পরিমাণের দিকে নজর দিতে পারি না।
এমনকি কোন একটি পরীক্ষাগারে বসেও যদি গল্প করার মতো কেউ পাশে থাকে তাহলে মানুষ শুধু পাস্তাও বেশি পরিমাণে খেয়ে ফেলে।
এই জ্ঞানকে খাবার খাওয়ার বাজে স্বভাব পরিত্যাগ করতে ব্যবহার করা হয়। “যখন আমরা মানুষকে কম খাওয়ায় সহায়তা করতে চাই তখন আমাদের উচিত তার অভ্যস্ত খাবারের আকাঙ্খাকে ‘অনভ্যাসে’ পরিণত করা।
এখানে আমাদের নিশ্চিত করতে পারতে হবে যে, একবার ভাল কোন কিছু খাওয়ার মানে এই নয় যে, আগামীকালও সেই খাবার আবার খেতে হবে,” বলেন ভ্যান ডেন আক্কার। এটা বেশ গুরুত্বপূর্ণ কারণ গবেষণায় দেখা গেছে যে, খাবার খাওয়ার ভাল কোন অভ্যাস একবার ভাঙার পর সেখানে খাবার খাওয়ার খারাপ একটি অভ্যাস গড়ে উঠেছে।
সম্ভবত এটা কোন আশ্চর্যের বিষয় নয় কারণ পরিবার বা বন্ধুদের সাথে বেশি পরিমাণে খাবার খাওয়ার পর আমার আবার ক্ষুধার্ত অনুভব করি। পরের দিন আমাদের আবার ক্ষুধা লাগে- অথবা এমনকি ওই দিনই পরের দিকে আবার ক্ষুধা লাগে- তার মানে এই নয় যে আমাদের পাকস্থলী প্রসারিত হয়েছে, বরং আমরা বিশেষ অনুষ্ঠানের সময় বেশি খেয়ে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছি।
তাই উৎসবের বিশাল খাবার-দাবারের পরের দিন যদি আমাদের মস্তিষ্ক খাবার গন্ধ, চিত্র বা শব্দের সংকেত পায়, তাহলে এটি আমাদেরকে দ্বিতীয় দফা আরেকবার খাবারের জন্য প্রস্তুত করে।
সোর্স: বিবিসি
Post a Comment