ঢাকা থেকে বান্দরবান এর বিভিন্ন দর্শনীয় স্থান কিভাবে ভ্রমন করবেন জেনে নিন

 বান্দরবান ভ্রমণ, নেটওয়ার্ক এর বাইরে ৩ দিন!!

গত ১৪-১৮ ফেব্রুয়ারি, ২০২০ আমরা ৩ জন ঘুরে আসি বান্দরবান থেকে, প্ল্যান ছিল নিচের মত।

ঢাকা-বান্দরবান-থাঞ্চি-রেমাক্রি-নাফাখুম-জিনাপারা-আমিয়াখুম-ভেলাখুম-নীলগিরি-চিম্বুক

(৫ দিন ৪ রাত)

১ম দিনঃ (ঢাকা-বান্দরবান)

সকাল সোয়া আটটায় সেন্টমার্টিন হুন্দাই এর এসি বাসে চেপে ঢাকা থেকে বান্দরবান এর উদ্দেশ্যে রওনা করি আমরা দুই বন্ধু। আরেকজন চিটাগং থেকে ডিরেক্ট বান্দরবানে আমাদের সাথে জয়েন করবে। হুন্দাই এর আরামদায়ক সিটে শুয়ে-বসে আড্ডা আর ঘুমে ঘুমে আমরা গন্তব্যে পৌছাই বিকাল ৪:১৫ এর দিকে। নেমে যাই হিল্টন হোটেল এর সামনে। একেত শুক্রবার, তার উপর ১৪ ফেব্রুয়ারি, ভয়ে ছিলাম ভাল হোটেল পাব কিনা। ওখানে একজন আমাদের পরামর্শ দিল আজকে থাঞ্চি গিয়ে থাকতে, তাহলে কম খরচে থাকাও হবে আবার কালকের জন্য ৩ ঘন্টা এগিয়ে থাকাও হবে। কিন্তু আমরা থাঞ্চির গাড়ী ম্যানেজ করতে না পারায় পরে বান্দরবানেই থেকে যাই। থাকি হোটেল হিল ভিউ তে। সন্ধ্যায় সাঙ্গু নদীর পাড় আর শহরে ঘুরে বেড়াই।

২য় দিনঃ (বান্দরবান-থাঞ্চি-রেমাক্রি-নাফাখুম-জিনাপাড়া)

ট্যুরের সব থেকে লম্বা জার্নির দিন। ফজর এর নামাজ পড়ে একদম কাকডাকা ভোর এ তাই চলে যাই চাদের গাড়ীর কাউন্টার এ। বাইরে তখন প্রচন্ড ঠান্ডা আর কুয়াশা। কাউন্টার এ দুই জনের আরেকটা গ্রুপ পাই যাদের সাথে মিলে আমরা টোটাল ৫ জন একটা জীপ ভাড়া করি, গন্তব্য থাঞ্চি। পাহারের গা বেয়ে কুয়াশার চাদর ভেদ করে আমরা চলতে থাকি। পথে দুই জায়গায় চেকপোস্ট পরে, একটা সাইরুর আগে যেখানে NID দেখতে চায়; আরেকটা বলিপারা তে, ওখানে সবার NID এর কপি জমা নেয়। সব শেষ করে থাঞ্চি পৌছতে বাজে সকাল ১০টার মত। থাঞ্চি নেমে গাইড এর সাথে দেখা করি। আমাদের গাইড জোয়াকিম ত্রিপুরা, খুবই অমায়িক এবং নিরীহ টাইপ এর মানুষ। তিনি আমাদেরকে সাথে নিয়ে থাঞ্চি থানা, বিজিবিসহ সবখানে এন্ট্রির কাজ শেষ করে নৌকায় উঠার জন্য থাঞ্চি ঘাটে নিয়ে যান। এর মধ্যেই আমরা যে যার বাসায় ফোন এ কথা বলা সেরে নেই, কারণ থাঞ্চির পর আর মোবাইল নেটোয়ার্ক পাওয়া যাবেনা। আমরা সাথে লাইফ জ্যাকেট নিয়েছিলাম (যদিও সেটা কাজে আসে নাই কোন)। অবশেষে আমরা নৌকায় উঠে রেমাক্রির উদ্দেশ্যে যাত্রা করি। সরু ডিঙি টাইপ এর নৌকা, সর্বোচ্চ ৫ জন বসা যাবে, সাথে গাইড আর ২ মাঝি। নৌকা চলছে, ইঞ্জিন এর ভট ভট শব্দ উপেক্ষা করে আমাদের চোখ চলে যায় সাঙ্গু নদীর দুই পাশের পাহার আর রূপ বৈচিত্রে। অবাক করা সব পাহারের মাঝে হঠাৎ করে হয়ত চোখে পরবে দুই চারটা বাড়ি, দোকান, অথবা জুমচাষী। পথিমধ্যে পরে তিন্দু, যেটা বড় পাথর নামেও পরিচিত। এই বিশাল সাইজের পাথর গুলো নিয়ে লোকমুখে অনেক মিথ প্রচলিত, আছে পাথরগুলোর আলাদা নামকরণও। প্রায় ২ ঘন্টা পর আমরা রেমাক্রি পৌছে নামায পরে দুপুরের খাবার সেরে নেই। রেমাক্রি থেকে শুরু হয় পায়ে হেটে ট্রেকিং, কখনো পাথুরে পথ, কখনো ঝিরিপথ, আবার কখনোবা উচু নিচু ঢালু পথ ধরে। ট্রেকিং এর সময় ২/১ জায়গায় দোকান পরবে, সেখান থেকে চাইলে চা নাশতা করে নেয়া যায়। প্রায় ৬ কিমি পথ ট্রেকিং করে আমরা যখন নাফাখুম পৌছাই তখন ঘড়িতে বিকাল ৪:২০, সবাই ক্লান্ত পরিশ্রান্ত, কিন্তু থেমে যাবার উপায় নেই, আমাদের আজকে জিনাপাড়া যেতেই হবে। তাই কিছুক্ষণ নাফাখুম এর সৌন্দর্য উপভোগ করে, আসর এর নামায পড়ে আবার হাটা শুরু করি। তবে যারা একটু বেশি সময় নিয়ে ঘুরতে আসবেন তারা চাইলে রাতে নাফাখুম পাড়া তে থেকেও যেতে পারেন।

জিনাপাড়া যেতে যেতে মনে হল এই পথ নাফাখুম এ আসার থেকে আরো কঠিন। পাথুরে উচু নিচু পথ, অসাবধানতায় একটু পা হড়কালেই হতে পারে বড় বিপদ। হাটতে হাটতে পথেই সন্ধ্যা নেমে এল, তখন সাথে করে নিয়ে আসা টর্চ টা ভাল কাজে দিল। আরো প্রায় ৬ কিমি বা তার বেশি পথ পাড়ি দিয়ে আমরা যখন জিনাপড়া পৌছাই তখন ক্ষুধায় আর কারো শরীর চলছিল না। গাইড এর ঠিক করে রাখা বাড়িতে উঠে আমরা বিশ্রাম করি, নামায সেরে নেই। জিনাপাড়া তে বিদ্যুৎ নেই, তবে প্রায় সব বাড়িতেই সৌর বিদ্যুৎ আছে। রাতে আমরা পাহারী মুরগী, আলু ভর্তা আর জুম চাষের ভাত দিয়ে ভরপেট খেয়ে ক্ষানিক বাদেই গভীর ঘুম এ তলিয়ে যাই।

জিনাপাড়া


৩য় দিনঃ (জিনাপাড়া-আমিয়াখুম-ভেলাখুম)

আগের দিনের ক্লান্তি ঝেড়ে সকালে বের হতে হতে ৮টা বেজে যায়, আজকের গন্তব্য আমিয়াখুম আর ভেলাখুম। যাবার আগে একটামাত্র ব্যাগ এ সবার শুকনা কাপড়,তোয়ালে আর পানি নিয়ে তা আমাদের লোকাল গাইড কে দিয়ে রাখি, কারণ এই পথে নিজের শরীর নিয়ে ট্রেক করাই নাকি অনেক টাফ, সেখানে ব্যাগ আলাগা বার্ডেন হয়ে যায়। যাবার পথে দূর থেকে বিজিবি ক্যাম্প আর থুইসাপাড়ার দেখা মেলে। মজার ব্যাপার থাঞ্চির পরে নেটওয়ার্ক না পাওয়া গেলেও এই পথে যেতে যেতে সামনেই নিকোলাস পাড়ার সন্ধান পাওয়া গেল যেখানে নাকি মোবাইল এর নেটোয়ার্ক পাওয়া যায়। কারো জরুরী দরকার হলে সেখানে গিয়ে কল করে আসতে পারে। তিনটা ছোট ছোট পাহার পেরিয়ে আমরা চলে আসি শেষ বাধা দেবতা পাহারের চূড়ায়। এখান থেকে বেশ ঢালু পথ ধরে নেমে গেলেই আমিয়াখুম। প্রায় ৪০ মিনিট এর মত সময় লেগে যায় নামতেই। নেমে প্রথমে আমরা ভেলা নিয়ে ভেলাখুম যাই। ভেলাখুমের চারপাশের শুনশান নিরবতা আর দূর থেকে আসা ঝর্ণার কলকল ধ্বনি নিঃসন্দেহে আপনাকে নিয়ে যাবে অন্য এক জগতে। কিছুক্ষণ সেখানে ঝর্ণার পানিতে ফ্রেশ হয়ে নিয়ে চলে যাই আমিয়াখুম। এই শুকনো মৌসুমেও আমিয়াখুমে ভালই পানি পেলাম। আসলে এত কষ্ট করে ট্রেক করে এত দূরে কেনো আসতে হবে তার উত্তর পেতে হলে এই আমিয়াখুম আর ভেলাখুম দেখতে আসতে হবে হবে, ক্যামেরায় ধারণ করা ছবি ও যেন এর সৌন্দর্য বর্ণনায় ব্যর্থ হয়।  ঝর্ণার স্বচ্ছ পানিতে গোসল সেরে আরো কিছুক্ষণ সময় কাটিয়ে আমরা ব্যাক করি। যেই দেবতা পাহার নামাটাই মনে হচ্ছিল তখন বিশাল চ্যালেঞ্জ , ফিরতে গিয়ে মনে হল উঠা টা আরো কঠিন কাজ, একদম দম বের হয়ে যায়। প্রায় ১ ঘন্টা সময় লাগল এর চূড়ায় উঠতে। বাকি পথ পেরিয়ে বিকালের দিকে আমরা আবার জিনাপাড়া তে ব্যাক করি, সেখানেই রাতে থাকব। সন্ধ্যার দিকে পাড়া টা একটু ঘুড়ে বেড়াই, তারপর বসে গাইড এর সাথে আড্ডা দেই, তিনি তার জীবনের নানান অভিজ্ঞতা শেয়ার করেন।

আমিয়াখুম


৪র্থ দিনঃ (জিনাপাড়া-নাফাখুম-রেমাক্রি-থাঞ্চি)

এই পাহারী গ্রামগুলোর এক অদ্ভুত বৈশিষ্ট্য, সকালে আর রাতে ঘন কুয়াশা চাপিয়ে ব্যাপক ঠান্ডা পরে, আর দিনের বেলা সূর্য উঠার পরে আবার কটকটে গরম। সকালের ঘন কুয়াশায় কিছুক্ষণ আগুন পুহিয়ে নিয়ে আমরা জিনাপাড়া ত্যাগ করি। আজকের গন্তব্য থাঞ্চি এবং সেখানেই রাত্রিযাপন করব। জিনাপাড়া তে আসার দিন সন্ধ্যা হয়ে যাওয়ায় আশপাশের সৌন্দর্য টা বুঝতে পারিনি, আজ ফিরে যাবার দিন তা ভালভাবে উপভোগ করলাম। আমরা নাফাখুম পাড়া তে পৌছে সকালের হালকা খাবার খাই। তারপর ঝর্ণার সামনে কিছুক্ষণ সময় কাটিয়ে রেমাক্রির উদ্দেশ্যে রওনা হই, সেখানেই আমাদের জন্য থাঞ্চি যাবার নৌকা দাঁড়িয়ে থাকার কথা। আমাদের বোট বিকালের দিকে থাঞ্চি নৌকা ঘাটে নামিয়ে দেয়, আর সেই সাথে ৩ দিন নেটওয়ার্ক এর বাইরে থাকার পরে আমরা অবশেষে নেটওয়ার্ক এর ভেতরে ফিরে আসি। আমরা থাঞ্চি তে উঠি হোটেল প্রিয়ন্ত তে, সেখানে ব্যাগপত্র রেখে শহরে ঘুড়াঘুড়ি আর খাওয়া দাওয়া করি। সন্ধ্যায় থাঞ্চি ব্রিজ এর পাশে বেশ ভাল সময় কাটে।

৫ম দিনঃ (থাঞ্চি-নীলগিরি-চিম্বুক-বান্দরবান-ঢাকা)

সকালে আমরা ৩ জন একটি মাহিন্দ্র সিএনজি টাইপ গাড়ি ভাড়া করি থাঞ্চি থেকে বান্দরবান শহরে যাবার জন্য, পথিমধ্যে এটা নীলগিরি এবং চিম্বুক থামবে। এই গাড়ির স্পিড চাদের গাড়ি থেকে একটু কম, তবে আমরা গ্রুপ ছোট হওয়ায় এটাই নিতে হল। এই কয়দিন বান্দরবানের অপার্থিব সব সৌন্দর্য দেখে এসে নীলগিরি আর চিম্বুক আমাদের কাছে একদম ম্যাড়মেড়ে লাগল, এখানে হয়ত শুরুতে আসলেই ভাল হত। ছবি তুলে ঘুরেফিরে বান্দরবান শহরে ফিরে আসি দুপুরের দিকে। এই সময়ে বান্দরবান থেকে ঢাকা যাবার বাস পাচ্ছিলাম না, তাই আমরা বিআরটিসি তে করে চট্টগ্রাম চলে আসি, এবং সেখান থেকে ইউনিক বাসে করে ঢাকা ব্যাক করি এবং পৌছাই রাত ১২:৩০ এর দিকে।

খরচঃ

ঢাকা-বান্দরবান বাসঃ সেন্টমার্টিন হুন্দাই (এসি) - ১৪০০ টাকা

বান্দরবান হিল ভিউ হোটেল (১ রুম) - ১৫০০ টাকা

বান্দরবান-থাঞ্চি জীপ (রিজার্ভ) - ৫০০০ টাকা

থাঞ্চি-রেমাক্রি বোট রিজার্ভ (যাওয়া+আসা) - ৪৫০০ টাকা

লাইফ জ্যাকেট ভাড়া - ৫০ টাকা প্রতিদিন

রেমাক্রি তে দুপুরের খাবার - ১৫০ টাকা

জিনাপাড়া তে থাকা (প্রতিজন) - ১৫০ টাকা প্রতি রাত

জিনাপাড়া তে খাওয়া - দুপুর ও রাত ১৫০ টাকা মিল, সকালের নাশতা ১২০ টাকা মিল

ভেলাখুম এ ভেলা - ৩০০ টাকা

গাইড চার্জ (মূল গাইড+ লোকাল গাইড) - ৪৫০০ টাকা

থাঞ্চি তে প্রিয়ন্ত হোটেলে ভাড়া (১ রুম) - ৮০০ টাকা

থাঞ্চি-নীলগিরি-চিম্বুক-বান্দরবান মাহিন্দ্র গাড়ি (রিজার্ভ) - ৩০০০ টাকা

বান্দরবান-চিটাগং বিআরটিসি বাস (এসি) - ১৫০ টাকা

চিটাগং- ঢাকা ইউনিক বাস (নন-এসি) - ৪৮০ টাকা

লক্ষ্যণীয়ঃ

১। সবাই অবশ্যই NID কার্ডের ফটোকপি ৪-৫ টা সাথে করে নিয়ে যাবেন।

২। ভাল ট্রেকিং স্যান্ডেল নিয়ে যাবেন, আমি লোটো থেকে এক জোড়া কিনেছিলাম , বেশ ভাল সার্ভিস পেয়েছি।

৩। আমাদের গ্রুপ ছোট হওয়াতে খরচ বেড়ে যায়, আপনারা বড় গ্রুপ এ যাবার চেষ্টা করবেন।

৪। থাঞ্চি তে রবি আর এয়ারটেল এর সিগনাল ভাল, গ্রামীনফোন এর টা তেমন পাওয়া যায়না।

৫। পাহারীরা খুবই অমায়িক এবং সহজ সরল, তাদের সাথে দূর্ব্যবহার করবেন না।

৬। দয়া করে ঘুড়তে গিয়ে কেউ পরিবেশ দূষণ করবেন না। সব জায়গায় ডাস্টবিন পাবেন না, তাই প্লাস্টিক বা কাগজ জাতীয় ময়লা ব্যাগ এ করে নিয়ে এসে যেখানে ডাস্টবিন পাবেন সেখানে ফেলবেন।


লিখেছেন: Md Sariful Islam

Post a Comment

Post a Comment (0)

Previous Post Next Post